কবুতর শান্তির প্রতীক হিসেবে পরিচিত। পৃথিবীর সর্বত্র কবুতর দেখা যায়। মানুষ ও কবুতরের সম্পর্ক অতি প্রাচীনকালের। তবে কবে, কখন, কোথায় কবুতরের সঙ্গে মানুষের প্রথম সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা নিরে মতদে রয়েছে। জীব বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, কবুতরের সঙ্গে মানুষের প্রথম পরিচয় ঘটে আজ থেকে প্রায় ৫,০০০-৬,০০০ বছর আগে। প্রায় এক হাজার বছর আগে এদেরই একটি প্রজাতিকে পোষ মানিয়ে গৃহে পালন করা হয়েছে। প্রথম কোথায় এদের পোষ মানানো হয়েছিল তা নিয়েও যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন পিবিরার, কেউ বলেন ব্যাবিলনে, আবার অনেকে বলেন, মিশরিকরাই সর্বপ্রথম কবুতর পোষা শুরু করে। মানৰ সভ্যতার বিকাশে কতরের যথেষ্ট অবদান ও গুরুত্ব রয়েছে।
এ অধ্যায় শেষে আমরা-
গৃহপালিত কবুতরের উৎপত্তি পাহাড়ি কবুতর কোলাম্বা লিবিয়া থেকে যাদের দেখতে অনেকটা জালালি কবুতরের মতো। বিশ্বব্যাপী গৃহপালিত কবুতরের প্রায় ৬০০টি জাত রয়েছে। আর এদের একেকটির আকার, গঠন, রঙ, ওজন ও গুণাগুণ একেক রকম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জাতের কবুতর রয়েছে। আমেরিকার সিলভার ও হোয়াইট কিং; ইউরোপের হোমার, হোসা; জাপানের মুল্লি, চীনের গজবীন, ভারতের লাক্কা, গিরিবাজ, ময়ূরপঙ্খি, জ্যাকোবিন, ইরানের সিরাজি; মিসরের বাবরা ইত্যাদি বিখ্যাত কবুতরের জাত। এছাড়াও রয়েছে বল, চিল্লা, সুসাদ্দাম, সার্টিন, ট্রাম্পেট, টাম্বলার এবং আরও অনেক জাতের কবুতর। আমাদের দেশীয় জাতের কবুতরের মধ্যে গোলা, গোলি, ডাউকা, কাউয়া, হামকাচ্ছা, লোটন, মুক্কি ইত্যাদি প্রধান ।
বসত বাড়ীতে পারিবারিক ভিত্তিতে বা বাণিজ্যিকভাবে অল্প শ্রমে, অবসরকালীন সময়ে বিনা খরচে অথবা নাম মাত্র খরচে কবুতর পালন করে প্রচুর টাকা আয় করা যায়। কবুতরের মাংস হাঁস-মুরগির মাংসের চেয়ে অধিক সুস্বাদু এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ। বৃদ্ধ মানুষ, বাচ্চাদের এবং অসুস্থ রোগী বা সদ্য রোগমুক্ত ব্যক্তিদের জন্য কবুতরের মাংস এবং সুপ খুব উপকারী। বাজারে হাঁস-মুরগির মাংসের চেয়ে কবুতরের বাচ্চার চাহিদা বেশি। হাঁস মুরগি পালনে ঘরের আশেপাশে দুর্গন্ধ ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু কবুতরের ঘরে তেমন কোনো দুর্গন্ধ থাকে না।
কবুতর ঘন ঘন বাচ্চা দেয়। তিন চার সপ্তাহের মধ্যেই বাচ্চা খাওয়ার উপযোগী হয়। খোপে একজোড়া কবুতর থাকলে প্রায় প্রতি মাসে একজোড়া এবং খোপে ৬০-৬৫ জোড়া কবুতর থাকলে প্রায় প্রতি দিনই একজোড়া বাচ্চা কবুতর পাওয়া যাবে। এতে একটি ছোট পরিবারের প্রতিদিনের প্রাণিজ আমিষের অভাব অনেককাংশে পূর্ণ হতে পারে। এছাড়া হাঁস-মুরগির চেয়ে কবুতরের রোগব্যাধি অনেক কম হয় ।
শ্রেণির তাত্ত্বিক কাজ
সুবিধাসমূহ :
অসুবিধাসমূহ
কবুতরের তেমন কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। ডিম পাড়ার বাসা, ডিম ফুটানো, বাচ্চার যত্ন এবং খাদ্য সংগ্রহ কবুতর নিজে নিজেই করে থাকে। ৫-৬ মাস বয়সে কবুতর ডিম পাড়ে। এ সময় থেকে পুরুষ এবং স্ত্রী কবুতরের জোড়া একসাথে দিতে হয়। কবুতর একবার জোড়া হয়ে গেলে, তাদের বন্ধন সহজে ছিন্ন হয় না।
নতুন জোড়া তৈরি করতে হলে তাদেরকে এক হতে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত একসাথে আটকিয়ে রাখতে হয়। পুরুষ ও স্ত্রী কবুতর উভয়েই খড়কুটা সংগ্রহ করে ডিম পাড়ার স্থান ঠিক করে নেয়। ডিম দেয়ার পর পুরুষ ও স্ত্রী উভয়েই পালাক্রমে ডিমে তা দেয়। পুরুষ কবুতর দুপুরের দিকে এবং স্ত্রী কবুতর অবশিষ্ট সময় ডিমে তা দেয় ১৮ দিনের সময়ে ডিম থেকে বাচ্চা বেরিয়ে আসে। পুরুষ স্ত্রী দুজনেই একইভাবে সদ্য প্রস্ফুটিত বাচ্চাকে তা দেয় এবং ১ম থেকে ৪র্থ দিন পর্যন্ত এদের খাদ্য থলিতে প্রস্তুতকৃত মিল্ক খাইয়ে বাচ্চাদের বাঁচিয়ে রাখে। ১০ দিন পর্যন্ত কবুতর তাদের বাচ্চাদেরকে ঠোঁট দিয়ে খাইয়ে দেয়। পরে বাচ্চারা নিজে নিজে খাদ্য খেতে শিখে নেয়। কবুতরের খাদ্য থলি থেকে যে রস নিঃসরণ হয়ে থাকে সে নিঃসরণকে কবুতরের দুধ (Pigeon milk) বলা হয়।
কবুতরের খোপের সামনে বারান্দায় খাদ্য ও পানির পাত্র রাখতে হয়। গোসল করার সুবিধার জন্য বাসার সামনে একটি পাত্রে গোসলের পানি এবং অন্য একটি পাত্রে ছাই বা বালি রাখতে হয়। কবুতরের ঘরের মেঝে সব সময় শুকনা ঝরঝরে রাখতে হয়। প্রতি মাসে ১/২ বার খোপের ভেতরের লিটার পরিষ্কার করে দিতে হয় । কবুতর ৩-৪ বৎসর পর্যন্ত উর্বর ডিম উৎপাদন করতে পারে। বয়স বেশি হলে উৎপাদিত ডিম হতে বাচ্চা ফুটানোর সম্ভাবনা কমে যায়। এরা ১৫-২০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। বাচ্চা কবুতরের যাতে অধিক গরম বা ঠান্ডা না লাগে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মুরগির ন্যায় কবুতরও বছরে একবার পালক বদলায়। বর্ষাকালে পালক বদলানোর সময় এদের প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে হয়।
শ্রেণির তাত্ত্বিক কাজ
কবুতর চেনার উপায়
স্ত্রী এবং পুরুষ কবুতর চেনা বেশ কঠিন। তবে দীর্ঘদিন অবলোকনের পর চেনা সহজ হয়। কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে স্ত্রী এবং পুরুষ কবুতরকে পৃথক করা যায়।
পুরুষ কবুতর | স্ত্রী কবুতর |
১. তুলনামূলকভাবে আকারে বড়। ২. কবুতর দেখতে চটপটে এবং চঞ্চল। ৩. মলদ্বারে উঁচু মাংসল অংশ থাকে। ৪. স্ত্রী কবুতরকে ঘিরে ঘুরে ঘুরে ডাকে । ৫. ঠোঁট সামনের দিকে টানলে গলা নিজের দিকে নেয়ার চেষ্টা করে । ৬. দেহ চাকচিক্যপূর্ণ । | ১. আকারে পুরুষ কবুতরের চেয়ে ছোট। ২. দেখতে শান্ত এবং নমনীয় প্রকৃতির । ৩. মলদ্বারে উঁচু মাংসল অংশ থাকে না । ৪. এরা ঘুরে ঘুরে ডাকে না। ৫. ঠোঁট সামনের দিকে টানলে চুপ করে থাকে । ৬. দেহ চাকচিক্য নয় । |
পৃথিবীতে প্রায় ১২০ জাতের কবুতর পাওয়া যায়। বাংলাদেশে প্রায় ২০ প্রকার কবুতর রয়েছে। এগুলো কোনো নির্দিষ্ট জাতের নয়। বাংলাদেশের সর্বত্র এ সকল কবুতর রয়েছে। আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে সাধারণত এরা চড়ে বেড়ায়। বাংলাদেশের জলবায়ু এবং বিস্তৃর্ণ শস্যক্ষেত্র কবুতর পালনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। পূর্বে কবুতরকে সংবাদ বাহক, খেলার পাখি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু বর্তমানে এটি পরিবারের পুষ্টি সরবরাহ, সমৃদ্ধি, শোভাবর্ধনকারী এবং বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এদের সুষ্ঠু পরিচর্যা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সঠিকভাবে প্রতিপালন করে আর্থ সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখা যায় ।
কবুতরের জাতসমূহ
কবুতরকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা :
১. মাংস/স্কোয়াব উৎপাদনকারী জাত
২. সৌখিন জাত
৩. দেশি জাত
কারনাউ জাতের কবুতর
কারনাউয়ের ৫টি উপজাত রয়েছে। যথা- লাল, সাদা, হলুদ, কালো ও ডান । তবে এদের মধ্যে লাল ও সাদা কারনাউ স্কোয়াব উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয়। এ দুটির বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো।
ক. লাল কারনাউ :
১. উৎপত্তিঃ বেলজিয়ামের দক্ষিণাঞ্চল ও ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলে।
২. অত্যন্ত পরিশ্রমী পাখি ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। এরা কিং কবুতর থেকে কিছুটা ছোট আকৃতির।
৩. এরা সোজা হয়ে দাঁড়ায়। এদের দেহ মজবুত, পালক দেহে শক্তভাবে লেগে থাকে ।
৪. পায়ের নালায় কোনো পালক নেই।
৫. স্কোয়াবের গায়ের চামড়ার রঙ সাদা।
৬. ড্রেসড স্কোয়াব গোলগাল হয়ে থাকে।
৭. প্রাপ্তবয়স্ক কবুতরের ওজন প্রায় ৭০০ গ্রাম হয়ে থাকে।
৮. এদের দেহ লাল; তবে তার উপর কিছু সাদা রঙের ছোপ রয়েছে।
খ. সাদা কারনাউ :
১. সাদা কারনাউয়ের উৎপত্তি যুক্তরাষ্ট্রে।
২. এরা অল্প সময়ে বেশি উৎপাদন দেয়ার জন্য বিখ্যাত।
৩. আমেরিকায় এরা খুব ভালো উপজাতের স্কোয়ার উৎপাদনকারী কবুতর।
৪. এদের স্কোয়াবের চামড়ার রঙ কিছুটা গোলাপি।
৫. ক্ষোরারের ওজন প্রায় ৪৫০ গ্রাম হয়ে থাকে।
৬. এদেরকে স্পেসড ক্রেল ও বেলিজিয়াম লাল কারনাট থেকে উৎপন্ন করা হয়েছে।
কিং জাতের কবুতর :
ক. সাদা কিংঃ
১. ক্ষোয়াব উৎপাদনে এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় উপজাত।
২. সাদা রান্ট, সাদা মালটেস, সাদা ডুচেস ও সাদা হোমার থেকে এ জাতের কবুতর তৈরি করা হয়েছে।
৩. এদের দেহ মজবুত, পা পরিষ্কার, পায়ের নালায় কোনো পালক নেই ।
৪. পুরো দেহ সাদা পালকে শক্ত পোক্তভাবে মোড়ানো।
৫. লেজ খাড়া, দেহ মাংসল।
৬. প্রতিটি স্কোয়ারের ওজন প্রায় ০.৫ কেজি হলে বাজারজাত করা হয়।
৭. জবাই করার পর অর্থাৎ ড্রেসড স্কোয়াবগুলো তেমন একটা গোলগাল হয় না, বরং কিছুটা কোনাকৃতির হয়।
৮. প্রাপ্তবয়স্ক কবুতরের ওজন প্রায় ৭৩৫ গ্রাম হয়ে থাকে।
খ. সিলভার কিং :
১. স্কোয়াব উৎপাদনে এ উপজাতটি এক সময় বেশ জনপ্রিয় ।
২. বর্তমানে এদের জনপ্রিয়তা সাদা কিং থেকে অনেক কম।
৩. এ উপজাতের কবুতর রাষ্ট্র, মালটেস, হোমার ও মনডেইন থেকে তৈরি করা হয়েছে।
৪. এদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য অনেকটা সাদা কিংয়ের মতোই।
৫. আকার-আকৃতিতে ক্ষোরাব উৎপাদনকারী কবুতরের মধ্যে এরাই সবচেয়ে বড় হয় ।
৬. এদের স্কোয়াবের ওজনও সাদা কিংয়ের থেকে কিছুটা বেশি হয়।
৭. এরা সাদা কিংয়ের থেকেও বেশি পোষ মানে।
রান্ট জাতের কবুতর:
কবুতরের জাতের মধ্যে রান্ট জাতের কবুতর ফল সবচেরে বড় কবুতর। অন্য যে কোনো জাতের উৎপাদিত স্কোয়ারের চেরে এ জাতের উৎপাদিত কোৱাব বড় হয়। কিন্তু বছরে অন্যান্য জাতের চেরে কম সংখ্যক ক্ষোৱাব উৎপাদন করে।
শারীরিক বৈশিষ্ট্য
১. কবুতরেরা দেহ খুব এ ষ্ঠি হয়।
২. কবুতরের বুক মাটির সমান্তরালের চেরে উপরের দিকে থাড়া।
উপযোগিতা
এ জাতের কবুতর ক্ষোৱাব উৎপাদনের জন্য পালন করা হয়। বছরে ফোৱাৰ কৰ উৎপাদন করলেও উৎপাদিত ক্ষোরাব আকারে হয়।
জায়েন্ট হোমার জাতের কবুতর
বাণিজ্যিকভাবে স্কোয়াৰ উৎপাদনকারীগণের নিকট এই জাতের কবুতর খুবই জনপ্রিয় ।
বৈশিষ্ট্যসমূহঃ
১. ঘার হোমার কবুতরের প্রজান দক্ষতা অনেক বেশি।
২. শরীর কিছুটা লম্বাকৃতি হয় ।
৩. কিং কবুতরের মত শরীর বেশি আটোসাঁটো হয় না।
৪. শরীর প্রশন্ত এবং বুক গভীর হয়।
উপযোগিতা: অন্যান্য জাতের চেয়ে এ জাতের কবুতর বছরে অনেক বেশি স্কোয়ার উৎপাদন করে থাকে ।
ফ্রেন্স মনডেইন জাতের কবুতর:
বর্তমানে ফ্রেন্স মনডেইন স্কোয়াব উৎপাদনকারী কবুতর হিসেবে নতুনভাবে পরিচিত লাভ করেছে এবং জনপ্রিয় হয়েছে। এ জাতের কবুতরের অনেকগুলো উপজাত রয়েছে। উপজাতগুলোর মধ্যে রঙ্গীন উপজাতটি অধিক জনপ্রিয়।
শারীরিক বৈশিষ্ট্য।
১. এ জাতের কবুতরের দেহ খাট হয়।
২. শরীর খুব গভীর হয় ।
৩. বুক প্রশন্ত।
উপযোগিতা: এ জাতের কবুতর স্কোয়ার উৎপাদনের জন্য পালন করা হয়।
সুইচ মনডেইন জাতের কবুতর
এ জাত আমেরিকায় উন্নতি লাভ করছে। সাদা কিং কবুতরের উপজাতের সাথে এ জাতের কবুতরের চেহারার মিল রয়েছে।
বৈশিষ্ট্যসমূহঃ
১. এ জাতের কবুতন্ত্রের দেহ কিছুটা লম্বা এবং হালকা পাতলা ।
২. এটি বড় আকারের স্কোয়াব উৎপাদনের জন্য অধিক জনপ্রিয় ।
উপযোগিতা: ছোয়াব উৎপাদনের জন্য পালন করা হয়
গোলা জাতের কবুতর :
বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারতে এদের উৎপত্তিস্থল ।
বৈশিষ্ট্যসমূহ:
১. এ জাতের কবুতরের রং নীল, হালকা ও গাঢ় ধূসর রঙের হয়ে থাকে।
২. চোখের রং এবং পায়ের রং কিছুটা লালচে বর্ণের হয়।
উপযোগিতা : এ জাত স্কোয়ার উৎপাদনের জন্য খুবই জনপ্রিয়।
প্রতি জোড়া কবুতরের জন্য আলাদা আলাদা খোপ করে দিতে হয়। প্রতিটি খোপের দৈর্ঘ্য ১ ফুট, গ্রন্থ ১ ফুট এবং উচ্চতা ১ ফুট থাকে। অথবা ২ ফুট প্রস্থ ১ ফুট উঁচু এবং ১৬ ইঞ্চি গভীর, মাঝখানে দেয়ালসহ এমন খোপে দুই জোড়া কবুতর রাখা যায়। দাঁড়িয়ে আরাম করার সুবিধার্থে শোপের সামনে ৫-৬ ইঞ্চি বাড়তি অংশ বা বারান্দা রাখতে হয়। খোপে কবুতর প্রবেশের জন্য ৪ ইঞ্চি x ৪ ইঞ্চি মাপের দরজা থাকে। খোপের সামনে এক বাক্স খড় রেখে দিলে কবুতর নিজে নিজে ডিমে তা দেয়ার বাসা তৈরি করে নিতে পারে। অনেক কবুতর একসাথে পালন করতে হলে পাশাপাশি অনেকগুলো খোপ তৈরি করে একতলা বা বাছতলা বিশিষ্ট ঘর করা যেতে পারে তবে একসাথে একই ঘরে এক জোড়ার বেশি কবুতর রাখা উচিত হবে না।
শিকারি পাখি বা বন্যক্কর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য কবুতরের পর সাধারণ দুটির উপর মাটি হতে ৫-৬ ফুট উপরে বা বসত ঘরের চালের ছাউনির নিচে স্থাপন করে রাতের বেলা দরজা ভালোভাবে বন্ধ করে রাখতে হয়। মুক্ত আলো বাতাস প্রবেশের সুবিধার জন্য খোপের চারদিকে দু-একটি ছোট ছোট ছিদ্র রাখতে হয়। ঝড়বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষার জন্য খোপের উপরের দিকে ভাল করে ছাউনি দিতে হয়। কাঠ, বাঁশ, বেত, বা লতাপাতা দিয়ে কবুতরের ঘর তৈরি করা যায়।
ডিম পাড়ার জন্য কবুতর নিজেরাই বাসা তৈরি করে নেয়। খামারের ভেতরে নরম, শুল্ক খড়-কুটা রেখে দিলে তারা ঠোঁটে করে নিয়ে বাসা তৈরি করে নেয়। ডিম পাড়ার বাসা তৈরির জন্য ধানের খড়, শুকনো ঘাস, কচি ঘাসের ডগা জাতীয় দ্রব্যাদি উত্তম। শক্ত কোনো প্রব্যাদি দিয়ে বাসা তৈরি করলে সেখানে ডিম পাড়ার জন্য ফসলে কবুতর আঘাত পেতে পারে এবং অনেক সময় ডিম ভেঙ্গে যেতে পারে। ইদানিং কৃত্রিমভাবে তৈরি নেট প্যাড ব্যবহার করা হয়। খামারের জন্য কবুতর ক্রয়ের সময় বিবেচ্য বিষয়
(ক) সুস্থ, সবল সজাগ দৃষ্টিসম্পন্ন, চঞ্চল, সঙ্গী কবুতর কিনতে হবে।
(খ) পালক এবং মলদ্বার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হতে হবে।
(গ) ঠোঁট বা মুখ দিয়ে কোনো লালা বা মিউকাস পড়বে না ।
(ঘ) যে কোনো ধরনের আঘাত যুক্ত হতে হবে।
(ঙ) জোড়া হিসাবে কবুতর কিনতে হবে।
কবুতর কিনে বাক্স বা ঝুড়িতে করে আনার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন বাক্স বা ঝুড়িতে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের সুযোগ থাকে এবং কবুতর ভালোভাবে শ্বাস প্রশ্বাস নিতে পাৱে।
শ্রেণির তাত্ত্বিক কাজ
কবুতরের বাচ্চার খাদ্য :
ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার কমপক্ষে ৪-৫ দিন পর কবুতরের বাচ্চার চোখ ফোটে। এ সময়ে বাচ্চাগুলো কোনো দানাদার খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না। এ সময় স্ত্রী এবং পুরুষ কবুতর তাদের পাকস্থলী (ক্রপ) থেকে ঘন ক্রিম বা দধির মত নিসরণ করে যাকে কবুতরের দুধ বলে। এ দুধ অধিক আমিষ, চর্বি এবং খনিজ লবণ সমৃদ্ধ খাদ্য যা খেয়ে কবুতরের বাচ্চা বড় হয় এবং এক সপ্তাহ পর্যন্ত খেতে পারে। বাচ্চাগুলো যখন বড় হতে থাকে স্ত্রী এবং পুরুষ কবুতর উভয়ে দানাদার খাদ্যের সাথে দুধ মিশিয়ে ঠোঁট দিয়ে বাচ্চাদের খাওয়ায়। বাচ্চা বড় হয়ে নিজে খাদ্য গ্রহণ না করা পর্যন্ত এভাবে স্ত্রী ও পুরুষ কবুতর খাবার খাওয়াতে থাকে ।
প্রাপ্ত বয়স্ক কবুতরের খাদ্য:
কবুতরের জন্য তৈরিকৃত খাদ্য শর্করা, আমিষ, খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিন, চর্বি এবং খনিজ লবণ সমৃদ্ধ সুষম খাদ্য হতে হবে। কবুতর দানাদার জাতীয় খাদ্য বেশি পছন্দ করে, ম্যাশ বা পাউডার জাতীয় খাদ্য অপছন্দ করে। ছোট আকারের কবুতরের জন্য ২০-৩০ গ্রাম, মাঝারি আকারের জন্য ৩৫-৫০ গ্রাম এবং বড় আকারের জন্য ৫০-৬০ গ্রাম খাদ্য প্রতিদিন দিতে হবে। দানাদার জাতীয় খাদ্যের মধ্যে গম, ধান, ভুট্টা, সরগম, ওট শতকরা ৬০ ভাগ এবং লেগুমিনাস বা ডাল জাতীয় খাদ্যের মধ্যে সরিষা, খেসারি, মাশকলাই শতকরা ৩০- ৩৫ ভাগ সরবরাহ করতে হবে। কবুতরের ভিটামিন সরবরাহের জন্য বাজারে প্রাপ্ত ভিটামিন ছাড়া সবুজ শাকসবজি, কচি ঘাস সরবরাহ করা প্রয়োজন। প্রতিদিন ২ বার খাদ্য সরবরাহ করা ভালো। মাঝে মাঝে পাথর, ইটের কণা (গ্রিট) এবং হলুদের টুকরা দেয়া উচিত । কারণ এ গ্রিট পাকস্থলীতে খাবার ভাঙতে এবং হলুদ পাকস্থলী পরিষ্কার বা জীবাণুমুক্ত রাখতে সাহায্য করে। খনিজ উপাদানের জন্য বোন মিল, ঝিনুকের গুঁড়া, লাইম স্টোন মিশ্রিত খনিজ খাদ্য উপাদান ৩-৫% সরবরাহ করতে হবে। এই মিশ্রণ ডিম, ডিমের খোসা শক্ত করা ও ভাল হ্যাচাবিলিটির (Hatchability) জন্য অতীব প্রয়োজন ।
কবুতরের সুষম রেশন তৈরি:
কবুতরের খাদ্যের মধ্যে প্রায় ২২-২৫% প্রোটিন এবং ৩০০০-৩২০০ কিলোক্যালরি শক্তি থাকতে হয়। ডিম উৎপাদন ও ডিমের খোসার গঠন এবং হ্যাচাবিলিটি বৃদ্ধির জন্য গ্রীট জাতীয় খাদ্য উপকরণ ও সুষম খাদ্যে সংযুক্ত করতে হবে। সে হিসাবে কবুতরের সুষম খাদ্য তৈরির জন্য নিম্নলিখিত উপকরণ ব্যবহার করা হয়।
শ্রেণির তাত্ত্বিক কাজ
কবুতরের ১০ কেজি খাদ্যের একটি রেশন তৈরি কর যার মধ্যে ২২-২৫% প্রোটিন এবং ৩০০০- ৩২০০ কিলোক্যালরি শক্তি থাকবে।
কবুতরকে পানি সরবরাহ
প্রতিদিন পানির পাত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করে কবুতরকে দিনে ৩ বার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা উচিত। কবুতর যেহেতু ঠোঁট প্রবেশ করিয়ে ঢোক গেলার মাধ্যমে পানি পান করে সেহেতু পানির পাত্র গভীর হওয়া উচিত। দুই সপ্তাহ পর পর হালকা পটাশ মিশ্রিত পানি সরবরাহ করলে পাকস্থলী বিভিন্ন জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে।
বিভিন্ন প্রকার রোগ জীবাণু দ্বারা কবুতর আক্রান্ত হতে পারে। সাধারণত খাদ্য এবং পানির মাধ্যমে জীবাণু কবুতরের দেহে প্রবেশ করে। তাছাড়া অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা জনিত পীড়নের কারণেও অনেক সময় কবুতর দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। তাই কবুতরের খামার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখলে এবং গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলে রোগবালাই থেকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কবুতরের সংক্রামক রোগসমূহের মধ্যে সাধারণত রাণীক্ষেত, পিজিয়ন পক্স, হেপাটাইটিস, সালমোনেলোসিস, ককসিডিওসিস, ট্রাইকোমোনিয়াসিস এবং ছত্রাকজনিত রোগ গুরুত্বপূর্ণ । এছাড়া ভিটামিন বা খনিজ লবণের অভাবজনিত রোগ, বদহজম জনিত সমস্যা, গেঁটেবাত, অন্তঃপরজীবী যেমন কৃমি এবং বাহ্যিক পরজীবী যেমন: মাছি, উকুন ইত্যাদির মাধ্যমে কবুতর আক্রান্ত হতে পারে। কবুতরের গুরুত্বপূর্ণ রোগ বালাই সমুহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে দেয়া হলো ।
কবুতরের রাণীক্ষেত রোগ (Newcastle disease in pigeon)
Avian paramyzo virus-1 এ রোগের জন্য দায়ী। এ ভাইরাসটি সাধারণত খাদ্য যন্ত্র এবং স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করে। আক্রান্ত কবুতর থেকে সুস্থ কবুতরে এ রোগের জীবাণুর বিস্তার ঘটে। এ রোগে মৃত্যুহার শতকরা প্রায় ১০ ভাগ। মুরগির রাণীক্ষেত রোগের ভাইরাসের এন্টিজেনিক বৈশিষ্ট্যের সাথে এ ভাইরাসের এন্টিজেনিক বৈশিষ্ট্যের মিল রয়েছে।
রোগের লক্ষণ :
রোগ দমন: কবুতরকে টিকা প্রয়োগ এবং খামারের জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করে রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
কবুতরের বসন্ত রোগ (Pigeon pox)
পিজিয়ন পক্স নামক এক প্রকার ভাইরাস কবুতরের বসন্ত রোগের জন্য দায়ী। সাধারণত শরীরের পালকবিহীন অংশ যেমন: চোখ বা মুখের চারদিক, পা ইত্যাদি জারণায় এ রোগের ফোস্কা বা গুটি দেখা যায় ।
রোগের লক্ষণ:
১. আক্রান্ত কবুতরের চোখের পাতা ও চোখ ফুলে যায় ।
২. চোখ লাল হয়ে যায় এবং পানি পড়ে।
৩. ফোস্কা বা গুটিগুলো প্রাথমিক অবস্থায় ছোট থাকে কিন্তু পরবর্তীতে বড় হয়ে যাওয়ার দরুণ অন্ধত্ব দেখা দিতে পারে। যার ফলে খেতে না পেরে আস্তে আস্তে শুকিয়ে মারা যায়।
রোগ নির্ণয় :
শরীরের পালকবিহীন অংশ যেমন- চোখ বা মুখের চারদিক, পা ইত্যাদি জায়গায় ফোস্কা বা গুটি দেখেই সাধারণত এ রোগ নির্ণয় করা যায়।
রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা:
কোনো চিকিৎসা না থাকার দরুন খামারের জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনাই রোগ প্রতিরোধের প্রধান উপায়। আক্রান্ত কবুতরকে দ্রুত সরিয়ে নিয়ে, উৎপন্ন হওয়া ফোস্কা বা গুটিগুলোকে প্রতিদিন কমপক্ষে তিনবার করে আয়োডিন যৌগ, যেমন- পটাশ বা আরোসান দিয়ে মুছে দিতে হবে। এতে ফোস্কা বা গুটি কেটে জীবাণুর বিস্তার রোধ সম্ভব হবে।
কবুতরের সালমোনেলোসিস রোগ (Salmonellosis in Pigeon)
কারণ: সধারণত Salmonella প্রজাতির (Salmonella gallinarum, Salmonella pullorum) ব্যাকটেরিয়া এ রোগের জন্য দায়ী।
রোগ বিস্তার :
রোগের লক্ষণ:
১. আক্রান্ত কবুতরের ডাইরিয়া হয় এবং জেলির মতো হলুদ বা সবুজ পায়খানা করে।
২. কবুতর আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়।
৩. পা এবং পাখায় প্যারালাইসিস হয়।
৪. ডিম পাড়ার সমস্যা দেখা দেয় ।
৫. পা এবং পাখার গিড়া ফুলে যায় ও ব্যাথা হয় ।
৬. খাদ্য কম খায় অর্থাৎ ক্ষুধামন্দা হয়।
৭. ডিম উৎপাদন কমে যায় ।
রোগ নির্ণয় : প্যাথলজিক্যাল পরিবর্তন এবং ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করে এ রোগ নির্ণয় করা যায়।
রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা:
কার্যকরী অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করতে হবে। পশু চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা করতে হবে। রোগ প্রতিরোধের জন্য খামারে ব্যাকটেরিয়ার প্রবেশ রুদ্ধ করতে হবে এবং আক্রান্ত কবুতরকে খামার থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। জেন্টামাইসিন ৩০% পাউডার, ১ গ্রাম ২০ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে। টেট্রাসাইক্লিন ২৫% ১ গ্রাম ২০ লিটার পানিতে মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে।
অ্যাসপারজিলোসিস (Aspergillosis)
কারণ: Aspergillus fumigatus নামক ছত্রাক মূলত এ রোগের কারণ। এ জীবাণুটি প্রধানত শ্বাসযন্ত্রকে আক্রান্ত করে তবে শরীরের ভেতরের অন্যান্য কোষকেও আক্রান্ত করতে পারে।
রোগ বিস্তার :
১. ভিমের খোসার ভেতর দিয়ে এ রোগের জীবাণু জনে প্রবেশ করতে পারে।
২. আপন কবুতর থেকে শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে সুস্থ কবুতর আসনত হতে পারে।
৩. এ রোগে মৃত্যুহার শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে।
রোগের লক্ষণ:
১. কবুতরের শ্বাসকষ্ট হয়।
২. দেহে ঝিমানো ভাব আসে।
৩. খাবারের প্রতি অনীহা আসে এবং ওজন কমে যায়।
৪. ঘন ঘন পিপাসা হয় ও পানি পান করে।
রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা কার্যকরী ছত্রাক বিরোধী ঔষধ, যেমন- নাইস্টেট সিরাপ দিয়ে চিকিৎসা করতে হবে। রোগ প্রতিরোধের জন্য আক্রান্ত কবুতর খামার থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। নাইস্টেট সিরাপ ১ সিসি ১০ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
কবুতরের রক্ত আমাশয় (Coccidiosis) রোগ:
কবুতরের রক্ত আমাশয় রোগের কারণ: Eimeria গোত্রভূক্ত বিভিন্ন প্রজাতির প্রেটোজোয়া দ্বারা এ রোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে।
রোগ বিস্তার:
১. সংক্রমিত খাবারের মাধ্যমে রোগ ছড়াতে পারে।
২. পানি বা লিটার থেকে মুখের মাধ্যমে জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে।
৩. এ রোগের মৃত্যুহার শতকরা ৫০ ভাগ।
রোগের লক্ষণঃ
১. রক্ত মিশ্রিত ডায়রিয়া হয়।
২. ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়।
৩. ওজন কমে যায় ।
৪. আক্রান্ত কবুতরের খাদ্যনালীর বিভিন্ন অংশে রক্তক্ষরণ, রক্তমিশ্রিত অপাচ্য খাদ্য এবং যা দেখা যায় ।
রোগ নির্ণয় :
প্যাথলজিক্যাল পরিবর্তন এবং পায়খানা বা খাদ্য নালীর ভেতরের দিকের অংশ নিয়ে পরীক্ষা করে প্রটোজোয়া সনাক্ত করে এ রোগ নির্ণয় করা যায়।
রোগের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা:
কার্যকরী প্রটোজোয়া বিরোধী ঔষধ যেমন সালফার জাতীয় ঔষধ দিয়ে চিকিত্সা করতে হবে। রোগ প্রতিরোধের জন্য আক্রান্ত কবুতরের ঘর কার্যকরী জীবাণুনাশক দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে এবং খামারে কঠোর জৈব নিরাপত্তা বাজায় রাখতে হবে। ইএসবি ৩ এক গ্রাম ১ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ৩-৫ দিন খাওয়াতে হবে ।
সাধারণ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা
কবুতরের রোগ প্রতিরোধ করা গুরুত্বপূর্ণ। রোগ প্রতিরোধের জন্য কার্যকরী জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করতে হবে। এ ছাড়া ঘরে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ বাজায় রাখার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার নীতিমালাসমূহ মেনে চলতে হবে।
স্বাস্থ্যসম্মত খামার ব্যবস্থাপনা
খামার হতে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খামার ব্যবস্থাপনা বা খামারের জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বেশিরভাগ রোগই খামার ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পর্কযুক্ত। স্বাস্থ্যসম্মতভাবে খামার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করলে একদিকে যেমন বিভিন্ন রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে অন্য দিকে তেমনি মানসম্পন্ন বাচ্চা উৎপাদন হবে এবং অধিক লাভবান হওয়া যাবে। স্বাস্থ্যসম্মত খামার ব্যবস্থাপনার মৌলিক বিষয়গুলো নিচে তালিকাবদ্ধ করা হলো :
১. সঠিকভাবে সেড তৈরি করতে হবে যেন পর্যাপ্ত আলো প্রবেশ এবং বায়ু চলাচল করতে পারে ।
২. উপরে বর্ণিত উপায়ে সঠিক মাপে খোপ তৈরি করতে হবে ।
৩. কবুতর উঠানোর আগে খামারসহ ব্যবহার্য সকল যন্ত্রপাতি সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথমে পানি দিয়ে পরিষ্কার করার পর পানির সাথে কার্যকরী জীবাণুনাশক যেমন- ০.২-০.৫% সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড বা আয়োডিন দ্রবণ কোম্পানি কর্তৃক নির্দেশ মোতাবেক মিশিয়ে খামারে সংরক্ষণ করতে হবে।
৪. সুস্থ সবল কবুতর সংগ্রহ করতে হবে। প্রয়োজনে বাহ্যিক পরজীবী নিধনের জন্য ০.৫% ম্যালাথিয়ন দ্রবণে কবুতরকে গোসল করিয়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে কবুতরের মুখ এ দ্রবণে ডুবানো যাবে না। হাত দিয়ে মাথায় লাগিয়ে দিতে হবে। অন্তঃপরজীবী প্রতিরোধের জন্য কৃমিনাশক ঔষধ সেবন করাতে হবে।
৫. জীবাণুমুক্ত খাবার এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে। বিশেষ করে খাবার যাতে কোনো অবস্থাতেই অতিরিক্ত আর্দ্রতাযুক্ত না হয়। অতিরিক্ত আর্দ্রতাযুক্ত খাবারের মাধ্যমে অ্যাসপারজিলোসিস ও বিষক্রিয়াসহ জটিল রোগ হতে পারে।
৬. কবুতরের খোপ, দানাদার খাদ্য ও খনিজ মিশ্রণ সরবরাহের পাত্র, পানির পাত্র ও গোসল করার পাত্র এবং কবুতর বসার স্ট্যান্ড নিয়মিত পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে। জীবাণুমুক্ত করার জন্য সুপারসেপ্ট অথবা হেলামাইড ব্যবহার করা যেতে পারে ।
৭. খামারে মানুষের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রতিবার খামারে প্রবেশ করার পূর্বে এবং খামার থেকে বের হওয়ার সময় হাত ও পা অবশ্যই জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
৮. খামারে যাতে বন্যপাখি ও ইঁদুর জাতীয় প্রাণি প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কেননা বন্যপ্রাণি ও ইঁদুর দ্বারা রাণীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমা ও সালমোনেলাসহ গুরুত্বপূর্ণ রোগ খামারে আসতে পারে।
৯. শেড এবং খোপ নিয়মিত পরিষ্কার করে খামারের ভেতরের পরিবেশ অবশ্যই স্বাস্থ্যসম্মত রাখতে হবে।
১০. কোনো কবুতর অসুস্থ হলে দ্রুত আলাদা করে ফেলতে হবে। অসুস্থ বা মৃত কবুতর অভিজ্ঞ ভেটেরিনারিয়ানের মাধ্যমে পরীক্ষা করিয়ে কারণ জেনে অন্যান্য জীবিত কবুতরের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে ।
১১. খামারে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী মোকাবিলা করতে হবে।
টিকা প্রদান
খামারে রোগ প্রতিরোধের জন্য টিকা প্রয়োগ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কবুতরের প্রজননকালীন সময়ে প্যারেন্ট কবুতরগুলোকে রাণীক্ষেত রোগের ইনএকটিভেটেড (মৃত টিকা) প্রয়োগ করা উত্তম। টিকা প্রয়োগের কমপক্ষে ৩ সপ্তাহ পর বাচ্চা ফুটানোর জন্য ডিম সংগ্রহ করতে হবে। তবে বাচ্চা কবুতর উড়তে শেখার সাথে সাথেও টিকা প্রয়োগ করা যায়। জীবিত বা ইনএকটিভেটেড (মৃত) উভয় টিকাই প্রয়োগ করা যায়। জীবিত টিকা চোখে এবং মৃত টিকা চামড়ার নিচে বা মাংস পেশিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম টিকা (জীবিত) প্রয়োগের কমপক্ষে ১৫ দিন পর দ্বিতীয় টিকা বা বুস্টার ডোজ দিতে হবে।
জবের নামঃ বিভিন্ন জাতের কবুতর সনাক্তকরণ ।
কবুতর দুই উদ্দেশ্যে পালন করা হয়। যথা-মাংসের জন্য ও সৌখিনতা। এই দুই উদ্দেশ্যে অনেক জাতের কবুতর পালন করা হয়। এক্ষেত্রে কবুতর সংগ্রহ করে এবং সম্ভব না হলে বিভিন্ন প্রকার ছবি, তথ্য ও স্লাইডের সাহায্যে কবুতরের বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলিয়ে এদের সনাক্ত করা হয়।
পারদর্শিতা নির্ণায়ক / মানদণ্ড
(ক) ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরম (PPE)
খ) প্রয়োজনীয় কাঁচামাল
গ) প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি:
কাজের ধারা:
১) বিভিন্ন জাতের কবুতর সংগ্রহ করে পাশাপাশি খাঁচায় সাজিয়ে রাখ
২) সম্ভব না হলে তাদের প্রয়োজনীয় ছবি ও তথ্যযুক্ত স্লাইড সংগ্রহ কর।
৩) বিভিন্ন জাতের কবুতরের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য ও উৎপাদন সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ কর।
৪) নিরাপত্তা মূলক পোষাক যেমন অ্যাপ্রন ও হ্যান্ড গ্লোভস পরিধাণ কর ।
৫) বিভিন্ন জাতের কবুতর ধরে এদের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যসমূহ সনাক্ত করে সংগৃহীত তথ্যের সাথে মিল কর।
৬) কবুতরের জাতগুলো উৎপাদন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে এবং পালনের উদ্দেশ্য অনুসারে শ্রেণিবিভাগ কর।
৭) বিভিন্ন জাতের কবুতরের ছবি এঁকে এদের বৈশিষ্ট্যসমূহ চিহ্নিত করে লিপিবদ্ধ কর ।
১. মাংস/ স্কোয়াব উৎপাদনকারী বৈশিষ্ট্যসমূহ চিহ্নিত করে লিপিবদ্ধ কর-
২. সৌখিন জাত বৈশিষ্ট্যসমূহ চিহ্নিত করে লিপিবদ্ধ কর-
সতর্কতাঃ
১) বিভিন্ন জাতের কবুতর পৃথক ভাবে রেখে সাবধানতার সাথে পর্যবেক্ষণ করতে হবে যেন এক জাতের সাথে অন্য জাত মিশে না যায়৷
২) কবুতর সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যেন ছুটে না যায় ও গায়ে বিষ্ঠা না লাগে ।
জবের নাম : কবুতরের বাসস্থান তৈরী
যদিও প্রচলিত নিয়মে প্রতিজোড়া কবুতরের জন্য ১টি যোগ প্রয়োজন হয় কিন্তু বাচ্চা উৎপাদন ইত্যাদি বিষয় মাথায় রেখে প্রতি জোড়ার জন্য একটি অতিরিক্ত খোপ রাখা প্রয়োজন। কবুতরের বাসস্থান নিরাপদ, শক্ত খুঁটির উপর একক বা কলোনী আকারে তৈরী করা হয়।
পারদর্শিতা নির্ণায়ক / মানদণ্ড
১. কবুতরের ঘরের দৈর্ঘ্য ও গ্রন্থ পরিমাপ করা
২. নিরাপদ ও আরামদায়ক বাসা তৈরী করা
৩. ঘর তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করা
(ক) ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (PPE)
খ) প্রয়োজনীয় কাচামাল
গ) প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি:
কাজের ধারা:
১) কবুতরের ঘরের মাপ নির্ধারণ কর।
২) মাপ মোতাবেক টিনের চালা, বেড়ার কাঠ কাট।
৩) শক্ত ঘরের ফ্রেম তৈরী কর।
৪) মেঝের বিছানার জন্য ১/৪ ফাঁক রেখে মাচান তৈরী কর।
৫) ঘরের ফ্রেমের সাথে পর্যায়ক্রমে মাচা, বেড়া ও টিনের চাল সংযুক্ত কর ।
৬) প্রত্যেক জোড়া বাসস্থানের কবুতর যাতে উপরে নীচে উঠানামা করতে পারে সে জন্য ফাঁকা জায়গা রাখ ৷
৭) নিরাপত্তার জন্য ঘরের বাইরের দিকে একটি কমন দরজা রাখ বাকী অংশ তারজালি দিয়ে ঢেকে দাও ।
৮) ঘরের কাছাকাছি খুঁটির উপর পানির পাত্র রাখ ।
সতর্কতা:
১. অবশ্যই তারজালি দিয়ে ঘরের সামনের অংশ ঢেকে দিতে হবে যাতে হিংস্র প্রাণির আক্রমন থেকে কবুতর রক্ষা পায়।
২. কবুতরের বাসা উঁচু শক্ত খুঁটির উপর বসাতে হবে যেন ভেঙ্গে না যায় ও হিংস্র প্রাণির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।
জবের নামঃ কবুতরের সুষম খাদ্য তৈরী
কবুতর সাধারনত শস্য দানা খেয়ে থাকে। কবুতরের খাদ্য না ভেঙ্গে এ জন্য দানা আকারেই সরবরাহ করা হয়। তবে কবুতরের বাচ্চার দ্রুত বেড়ে উঠা, হাড় শক্ত ও পুরু হওয়া এবং ডিমের খোসা তৈরীর জন্য শস্য দানার পাশাপাশি গ্রিট বা কাঠ কয়লার চূর্ণ ব্যবহার করা হয়।
পারদর্শিতা নির্ণায়ক / মানদণ্ড
১) কবুতরের রেশনে ব্যবহৃত খাদ্য উপকরণ নির্বাচন করা
২) কবুতরের সুষম খাদ্য তৈরী করা
৩) খাদ্য তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করা
(ক) ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (PPE)
খ) প্রয়োজনীয় কাঁচামালঃ
প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি
কাজের ধারা:
১) প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ সংগ্রহ করো ।
২) কবুতরের প্রয়োজনীয় খাদ্য তালিকা সংগ্রহ করো ।
৩) তালিকা মোতাবেক খাদ্য উপকরণগুলো মেপে পৃথক করো।
৪) পর্যায়ক্রমে কম পরিমান ব্যবহৃত খাদ্য উপাদান ও পরবর্তীতে বেশি পরিমানে ব্যবহৃত উপকরণ গুলো মেশাও।
৫) মিশ্রিত খাদ্য বস্তায় বা পাত্রে রেখে পরবর্তীতে খাওয়ানোর জন্য সংরক্ষণ করো।
কবুতরকে খাদ্য সরবরাহের ২-৩ ঘন্টা আগে ভিজিয়ে রেখে খেতে দাও ।
নিম্নে কবুতরের খাদ্য তালিকা প্রদান করা হল
সতর্কতাঃ
১) কবুতরের খাদ্যে কোন মাংস বা ভাঙ্গা উপাদান যোগ না করা ভাল ৷ ২) খাদ্য উপকরণগুলো ভালভাবে মিশ্রিত করতে হবে যেন সর্বত্র মিশ্রিত হয় ।
অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১. কবুতর কীসের প্রতীক?
২. গ্রীস, মিশর, চীন প্রভৃতি দেশে কবুতর কী হিসেবে ব্যবহৃত হত?
৩. শোভাবর্ধনকারী দু'টি কবুতরের জাতের নাম লেখ ৷
৪. স্কোয়াব উৎপাদনকারী দু'টি কবুতরের জাতের নাম লেখ ।
৫. পাঁচটি দেশি জাতের কবুতরের নাম লেখ ।
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১. কবুতরের উৎপত্তি লেখ ।
২. কবুতর পালনের সুবিধাগুলো লেখ ।
৩. কবুতর পালনের অসুবিধাগুলো লেখ।
৪. কবুতরের শ্রেণিবিভাগ লেখ ।
৫. স্ত্রী ও পুরুষ কবুতরের মধ্যে পাথর্ক্য লেখ ।
রচনামূলক উত্তর প্রশ্ন
১. কবুতর খামারের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ব্যবস্থাপনার মৌলিক বিষয়গুলো বর্ণনা কর।
২. কবুতরের অ্যাসপারজিলোসিস রোগের কারণ, রোগ বিস্তার, লক্ষণ ও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বর্ণনা কর ।
৩. কবুতরের সুষম রেশনের একটি নমুনা তৈরি কর (আমিষ ২২-২৫% ও শক্তি ৩০০০-৩২০০ কিলোক্যালরী/কেজি)।
আরও দেখুন...